সিলেটের কানাইঘাটের দিঘীরপার পূর্ব ইউপির সাতবাঁক ঈদগাহ কবরস্থানে শায়িত আছেন ১৯৭১ সালে পাক-বাহীনির সাথে সম্মূখযুদ্ধে শহীদ হওয়া ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান ‘বীর উত্তম’। তার ডাক নাম খোকা। মাহবুবুর রহমান দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানার ভাদুরিয়া ইউপির পলাশবাড়ী গ্রামে ১৯৪৬ সালের ৩রা জুলাই এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অধ্যক্ষ মৌলভী তছির উদ্দিন আহমদ। মাতার নাম মোছা: জরিনা খাতুন। মাহবুবের পিতা দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেছেন এবং বিরামপুর কলেজ ও দিনাজপুর আদর্শ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। একজন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ হিসাবে দিনাজপুরের ইতিহাসে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যক্ষ তছির উদ্দিন আহমদের ৪ পুত্র ২ কন্যা সন্তান ছিল। ৬ সন্তানের মধ্যে মাহবুব ছিল তৃতীয়। মাহবুবুর রহমান খোকার ছাত্র জীবন কেটেছে দিনাজপুর শহরের কালিতলা মহল্লায়। তিনি কেজি ক্লাস থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন দিনাজপুর সেন্ট যোসেফ স্কুলে (মিশন স্কুল)। এরপর পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন।
১৯৬০ সালে জেলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর মাহবুব দিনাজপুর সুরেন্দ্র নাথ কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে আই,এস,সি পাশ করে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হন। ২ বছর ডেন্টাল কলেজে পড়াশুনার পর ১৯৬৬ সালে সবার অজান্তে সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। মাহ্বুব ছাত্র জীবনে একজন ভাল ক্রিকেট ও লন টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক জোনে তিনি লনটেনিস চ্যাম্পিয়ান খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কমিশন র্যাঙ্ক ৪০ তম লং কোর্সে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে সেকেন্ড ল্যাফটেন্যান্ট হিসাবে কমিশন প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে ল্যাফটেন্যান্ট পদে আজাদ কাশ্মীর ২৪ এফ এফ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) এ যোগদান করেন। পরবর্তীতে মাহবুবের ব্যাটালিয়ান পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা সেনানিবাসে চলে আসে।
১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান উত্তাল পটভূমিতে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয় এবং পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ অবধারিত হওয়ায় তিনি ২৪ শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস হতে গোপনে ঢাকায় চলে আসেন। ২৮শে মার্চের কালো রাত্রিতে যখন পাকিস্তানী সেনারা নারকীয় হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ ও বর্বতায় দেশের মাটি নিরীহ মানুষের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়, ঠিক তখনই কারফিউ চলাকালীন সেই সময়ে মাহবুবের অন্তরঙ্গ কয়েকজন ব্যাচমেট ও কিছু সামরিক অফিসারদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পায়ে হেঁটে ভারতের আগরতলায় পৌছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল আতাউল গনী ওসমানির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধা রিক্রটিং ক্যাম্পে ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ শুরু করেন। সর্বাধিনায়কের নির্দেশে ক্যাপ্টেন মাহবুব বেঙ্গল রেজিমেন্ট জেড ফোর্সভুক্ত ‘আলফা বাহিনী’র কমান্ডার হিসাবে সিলেটের পূর্বাঞ্চলের রণাঙ্গনে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নিয়ন্ত্রনাধীন ৮০০ সৈনিক নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস দেশকে শক্রুমুক্ত করার জীবন মরণ লড়াইয়ে নবনব বিজয় ছিনিয়ে আনতে থাকেন। শেষের দিকে যুদ্ধের ভয়াবহতা বাড়তে থাকে। যোগাযোগে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। পাকিস্তানী শত্রুসেনাদের ত্রিমুখী আক্রমণে সাময়িকভাবে দেখা দেয় বিভ্রান্তি। রশদ ফুরিয়ে যায়। ঠিক সেই সময়ের যুদ্ধকালীন প্রত্যক্ষদর্শী সহযোদ্ধাদের বর্ণনা মতে জানা যায় ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে সকলে গাছের কাঁচা ফলমূল ও শাকপাতা খেয়ে কোন রকমে পেট ভরানোর কাজটি সারা হতো। প্রতি মুহূর্তে আক্রমণের আশঙ্কা, অনিদ্রা ও উৎকন্ঠায় কেটেছে দিনের পর দিন।
অবশেষে যুদ্ধ শেষের দিনগুলোতে ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে তার “আলফা বাহিনী” বিজয়ের ঠিক দ্বার প্রান্তে যখন উপস্থিত, সিলেট শত্রু মুক্ত হবার জন্য প্রস্তুত, মুক্তির আনন্দে উড়বে স্বাধীন দেশের স্বাধীন পতাকা, জীবনে পরম পাওয়ার চরম দিনটি আসন্ন। ঠিক সেই সময়ের মাত্র তিনদিন আগে সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার ৩নং দিঘীরপাড় পূর্ব ইউপির কটালপুর এলাকায় সরাসরি সম্মুখযুদ্ধ চলছে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী সেনা শত্রুদের কামানের গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন মাহবুব ভীষণভাবে আহত হন। কটালপুরের উন্মুক্ত প্রান্তরে যখন ক্যাপ্টেন মাহবুব মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, চারদিক থেকে গোলাগুলি ছুটে আসছে সেই সময়ে তার সহযোদ্ধারা তাকে নিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তখনও ক্যাপ্টেন মাহবুব নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও আদেশ দিচ্ছেন- লিভ্ মি-গো-এহেড’। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ভয়ানক আক্রমণ। কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা ‘মেসাকার’ হয়ে গেল। সেই সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করলেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩০ জন সৈনিক সহযোদ্ধা। কানাইঘাটের দিঘীরপার রণাঙ্গণের মাটি ভিজে উঠলো ক্যাপ্টেন মাহবুবসহ বীর শহীদদের রক্তে। মুক্তিযুদ্ধে এ আত্মত্যাগ জন্মদিল এক গর্বিত স্বাধীন জাতির। সেনাবাহিনীর বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ যেমন প্রাক্তন মন্ত্রী অবঃ ল্যাফটেন্যান্ট কর্ণেল জাফর ইমাম (বীর প্রতীক), অবঃ মেজর জেনারেল এজাজ আহমদ চৌধুরী (বীর বিক্রম), অবঃ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারুক আহমদ সাবেক পাটমন্ত্রী, অবঃ মেজর এম হাফিজ উদ্দীন আহমদ (বীর বিক্রম) সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী, অবঃ কর্ণেল তফছির আহমদ, সাবেক সেনা প্রধান ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান মাসহুদ চৌধুরী, মেজর জেনারেল আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার গিয়াস উদ্দিন, ব্রিগেডিয়ার জাহাঙ্গীর আলম, মেজর জেনারেল জালাল উদ্দীন, ব্রিগেডিয়ার খালেক, মেজর জেনারেল মাহাফুজ, মেজর জেনারেল সাইফ সহ রণাঙ্গণের সাথী সহযোগীরা তাঁর সমাধীস্থলে মনোরম “স্মৃতি স্বরণী” স্থাপনা করে শহীদ স্মৃতিকে অমলিন করে রেখেছেন।
বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন মাহবুবের বিরোচিত স্বীকৃতি স্বরুপ “বীর উত্তম” রাষ্ট্রীয় উপাধিতে ভূষিত করে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার স্মৃতিকে অম্লান রাখতে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানায় খোলাহাটিতে অবস্থিত সেনানিবাসের নামকরণ “শহীদ মাহবুব সেনা নিবাস” করে তাদের নিখোঁদ দেশ প্রেমের ঐতিহ্য এবং শহীদ মর্যাদাকে সূদুঢ় করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর শহীদেরা যে স্বপ্ন ও আদর্শকে বুকে নিয়ে অমূল্য সম্পদ নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিয়ে ‘স্বাধীনতা’র সেই মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই মূল্যবোধে আমরা কতটুকু ধারণ, পালন, লালন, করেছি-আজকের দিনে এই হোক আমাদের আত্ম জিজ্ঞাসা। কারণ আত্ম বিস্মৃত জাতি কখনই ইতিহাস হয়না। আজ সময় এসেছে চরম সত্যের মুখোমুখি হবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদরা আমাদের গর্ব। আর দিনাজপুরের সেই গর্বিত সন্তান শহীদ ক্যাপটিন মাহবুবুর রহমান মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কানাইঘাটের দিঘীরপারে শহীদ হয়ে শায়িত আছেন। সেই মহান বীর ‘বীর উত্তম’ এর বীরত্ব গাঁথা স্মৃতি গুলো আজও ভুলেনি কানাইঘাটবাসী।
Posted ১০:০২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০১৯
Sylheter Janapad | Sylheter Janapad