ফাইল ছবি
নির্মাণকাজ সম্পন্ন এবং উৎপাদনের সাফল্য নিশ্চিত করে হস্তান্তর করা হয়েছে ফেঞ্চুগঞ্জে নবনির্মিত শাহজালাল সারকারখানা। সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার চীনা অর্থায়নের এই প্রকল্পটি নির্ধারিত মেয়াদেই বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে চীন। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির অত্যাধুনিক এই ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নির্মাণের পর চায়নীজরাই ২ বছর কারখানাটিকে পরিচালনা করে। দেশীয় প্রকৌশলীরা প্রশিক্ষিত হয়ে উঠলে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়নার মেসার্স কমপ্লান্ট এবং প্রশিক্ষক কোম্পানী মেসার্স ঝাংফু তাদের নিজ দেশে ফেরে যায়।
ইতিমধ্যে দুইবার যান্ত্রিক ত্রুটিতে সারকারখানা বন্ধ হলেও চাইনিজ কোম্পানী ছাড়াই এটিকে দেশীয় প্রকৌশলীরা ফের চালু করে উৎপাদনে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। ফলে দেশের মাটিতে গড়ে ওঠা বিদেশী ওই শিল্প প্রতিষ্ঠানটিকে পরিচালনায় সারকারখানার প্রকৌশল বিভাগ এখন আত্মবিশ্বাসী।
শাহজালালের পূণ্যভুমি এবং হযরত মাইয়াম শাহের স্মৃতিবিজড়িত ভুমিতে স্থাপিত শাহজালাল সারকারখানায় উৎপাদন শুরু থেকেই উর্ধ্বমুখী। ফলে নতুন এই সারকারখানা নিয়ে সার শিল্পে নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচন হয়েছে। শিল্প শহর ফেঞ্চুগঞ্জে প্রথম সারকারখানা নির্মিত হয়েছিল ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। ন্যাচারাল গ্যাস ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি (এনজিএফএফ) নামে ফেঞ্চুগঞ্জের ওই পুরাতন সারকারখানা স্থাপন করেছিল জাপানের কোবেষ্টীল লিমিটেড। ২০ বছরের ইকনোমিক লাইফ নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পুরাতন ওই সারকারখানা চলেছিল প্রায় অর্ধ শত বছর। ১৯৬১ সালের ১৩ই ডিসেম্ভর এনজিএফএফ যাত্রা শুরু করে। জরাজীর্ণ হয়ে গেলেও ওই কারখানা ২০১২/১৩ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে। শাহজালাল সারকারখানার ইকনোমিক লাইফও ২০ বছর। যথাযত রক্ষানাবেক্ষনে এটিকেও দীর্ঘদিন চালু রাখা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞমহলের অভিমত।
জানা যায়, শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি প্রকল্পটি চীন বাস্তবায়ন করলেও এতে আমেরিকা ও ন্যাদারল্যান্ডসের প্রযুক্তি থাকায় এই সারকারখানা অনেক টেকশই হবে। শাহজালাল সারকারখানা প্রধান প্লান্ট ইউরিয়া ও এ্যামোনিয়ার প্রসেস লাইসেন্সর হচ্ছে এ্যামোনিয়ায় আমেরিকার বিখ্যাত কোম্পানি কিলোগ ব্রাউন এন্ড রোটস (কেবিআর ) ইউরিয়ায় ন্যাদারল্যান্ডসের খ্যাতিমান কোম্পানি ষ্টেমিকার্বন বি, ভি ।
এসএফপির ট্যাকনিক্যাল বিভাগ সুত্র জানায়, যাত্রা শুরুর প্রায় এক বছর পর এ্যামোনিয়া প্লান্ডের জন্য আমেরিকা থেকে কেবিআরের ও,এ, এস, ই, সল্যুশন নামের ক্যামিকেল ফেঞ্চুগঞ্জে আসতে দেরী হওয়ায় মেশিনগুলোতে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওভারহোলিংয়ে ওই সমস্যাগুলো সেরে ফেলা যাবে বলে সুত্র জানায়।
সম্প্রতি শাহজালাল সারকারখানা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে উৎপাদনের বাস্তবচিত্র। শাহজালাল সারকারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: মনিরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে নিজস্ব প্রকৌশলী দ্বারাই সারকারখানার সব সেকশন পরিচালিত হচ্ছে। উৎপাদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে দৈনিক ১১শ টন সার উৎপাদন হচ্ছে। সারের চাহিদা কিছুটা কম থাকায় এবং গোডাউনে পর্যাপ্ত স্থান সংকুলান না হওয়ায় বর্তমানে উৎপাদন প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে রাখা হয়েছে। গত ১৬ই জুন থেকে সারকারখানা বন্ধ রেখে প্রথম ওভারহোলিং ( সংস্কার) কাজ করা হচ্ছে। এতে প্রাক্কলিত ব্যায় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। তিনি জানান, চলতি বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লক্ষ ২০ হাজার টন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
২০১২ সালের ২৪শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজালাল সারকারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার পর কুচক্রিমহল এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা নেতিবাচক প্রসঙ্গের অবতারনা করেন। ওই মহল এমনও বলেন যে গ্যাসের কারনে শাহজালাল সারকারখানা চালু করা সম্ভব হবেনা। তৎকালীণ সরকারে ঘাপটি মেরে থাকা সিলেট বিদ্বেষী ওইমহলের মুখে চুনকালি দিয়ে শাহজালাল সারকারখানা শুরু থেকেই উৎপাদনে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। এমনটাই জানালেন, বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) জনৈক কর্মকর্তা। শাহজালাল সারকারখানা শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি মালেক চৌধুরী জানান, ফেঞ্চুগঞ্জে পুরাতন সারকারখানার পাশে নবনির্মিত শাহজালাল সারকারখানা দেশের বৃহত্তম ও সফল শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। তিনি বলেন, এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশাল জনগোষ্টির কর্মসংস্থান এবং জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে।
শাহজালাল সারকারখানা সার শিল্পে নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। ফেঞ্চুগঞ্জ তথা সিলেটবাসীর প্রাণের দাবী ছিল পুরাতন সারকারখানার পাশে একটি নতুন সারকারখানা স্থাপন। আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা দিয়ে কথা রাখায় তাঁর প্রশংসা যেন আজ এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে । ফেঞ্চুগঞ্জ নিজামপুর গ্রামের সমাজসেবি মুফতিউল ইসলাম চৌধুরী জানান, শাহজালাল সারকারখানা স্থাপিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতার ফলে। এখানে অত্যাধুনিক এই সারকারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গোটা এলাকার চিত্রই পাল্টে গেছে। অত্যাধুনিক এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ফেঞ্চুগঞ্জে মাহমুদ উস সামাদ ফারজানা চৌধুরী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় ভিডিও কনফারেন্সে সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর দাবীর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজালাল সারকারখানা স্থাপনের আশ্বাস প্রদান করেন। সরকার গঠনের ২ বছর পরই চীনে গিয়ে সারকারখানা স্থাপনে চুক্তি করে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্যাপারটি সরকার প্রধানের আন্তরিকতার পরিচয় হিসেবেই দেখছেন স্থানীয় জনতা।
এসএফপি এবং চীনা সুত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে চীন বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেয় তাদের তৈরী শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নামের এই শিল্প প্রতিষ্ঠান। আমেরিকা ও ন্যাদারল্যান্ডসের প্রযুক্তিতে চীন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। এতে ব্যয় হয় ৫ হাজার ৯শ কোটি টাকা। অত্যাধুনিক এই সারকারখানা চালু হলেও দেশীও প্রকৌশলীরা এর সার্বিক দায়িত্ব বুঝে নিতে প্রায় ৩ বছর সময় লাগে। এই সময়ে চীনা প্রকৌশলীরা তাদের প্রশিক্ষন প্রদান করেন। যদিও পরিচালনা বাবদ চীনা কোম্পানীকে ৩ বছরে অতিরিক্ত ১শ ২০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে বেতন বাবদ।
দেশের বৃহত্তম ওই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে তাতে শতভাগ উৎপাদন শুরু হওয়ায় ২০১৬ সালে লিখিতভাবে হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির শাহজালাল সারকারখানা পরিচালানায় চীনা প্রকৌশলীরা প্রায় ৩ বছর ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থান করে দেশীয় প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষন প্রদান করে। সবকিছু ঠিকটাক হওয়ায় চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রশিক্ষক কোম্পানী চায়নার মেসার্স ঝাংফু তাদের লোকবল নিয়ে নিজ দেশে ফেরে যায়।
বর্তমানে দক্ষতার সাথে সারকারখানার সব সেকশন পরিচালনা করছেন দেশীয় প্রকৌশলীরা। সুত্র জানায়, চলতি বছরের এপ্রিলের ৯ এবং ১৫ তারিখ বজ্রপাতজনিত কারণে সারকারখানার নিজস্ব পাওয়ার প্লান্ট ট্রিপ করে সব মেশিন বন্ধ হয়ে গেলেও দেশীয় প্রকৌশলীরা দক্ষতার সাথে শাহজালাল সারকারখানার সব প্লান্টগুলো চালু করে ফের উৎপাদনে নিয়ে যান। শাহজালাল সারকারখানার হিসেব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আব্দুল বারেক জানান, ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্ব থেকে চলতি বছরের ১০ মে পর্যন্ত শাহজালাল সারকারখানায় উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৬৭ টন সার। যার বাজার মূল্য ১৭শ ৭৫ কোটি ১৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে সরকারি কোষাগারে সার বিক্রি করে জমা দেয়া অর্থের পরিমান ১১০ কোটি টাকা। আন্তজার্তিক বাজার থেকে প্রতি টন সার কিনতে হলে সরকারের খরছ হয় ৩৪ হাজার টাকা। অপরদিকে শাহজালাল সারকারখানায় প্রতি টন সার উৎপাদনে খরছ হচ্ছে ২০ হাজার টাকা বলে জানান তিনি।
Posted ১:০৫ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২৪ আগস্ট ২০১৯
Sylheter Janapad | Sylheter Janapad