সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম সুনামগঞ্জে আসেন। ৭০ এর নির্বাচনের পূর্বে ভৈরব থেকে লঞ্চযুগে আজমিরীগঞ্জ হয়ে শাল্লা, দিরাইসহ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন থানায় সমাবেশ করেন। ভাটিবাংলার রাজধানী জ্যোৎনার শহর সুনামগঞ্জের সাথে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ এক সম্পর্ক ছিল। সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বহু রাজনৈতিক সহচরের জন্ম হয়েছে।
সুনামগঞ্জের ভিখ্যাত গনসঙ্গীত রচয়িতা, সিলেটে প্রথম আযান ধ্বনি বাবায় দিয়াছে বা হুমায়ুন আহমেদের প্রিয় সঙ্গীত মরিলে কান্দিসনা আমার দায় গানের গীতিকার ও সুরুকার সঙ্গীত সাধক মরমি কবি গিয়াস উদ্দিন ধন্যবাদ হে বঙ্গবন্ধু বাংলার নয়নমনি গানটি গেয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সুনামগঞ্জে নির্বাচনী সমাবেশ করেন।
১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অত্যন্ত আলোচিত সুনামগঞ্জের ধীরাই-শাল্লা আসনে প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও ন্যাপের সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। প্রার্থী দুজন প্রচন্ড প্রভাবশালী। কবির ভাষায় কেহ কাওে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।হাড্ডা হাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা। নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ঘুম হারাম। এর মধ্যে আবার ন্যাপের সাংঘঠনিক সম্পাদক আগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী এসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পক্ষে নির্বাচনী সমাবেশ করে গেছেন।তাই আওয়ামী লীগের নতা-কর্মী-সমর্থকরা দাবি তুললেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ও দিরাই আসতে হবে।
একদিন নির্বাচনী মিছিল শেষে আযোজিত সমাবেশে জননেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ঘোষনা দিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিরাই আসছেন। আমনি বিশাল সমাবেশে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ল। জয়বাংলা সহ নানা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল চারদিক। নৌকার পক্ষে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সে কি উচ্ছ্বাস। প্রিয় নেতা দ্বিতীয়বারের মত আসছেন ভাটির জনপদে। এর চেয়ে বড় আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তখন ভীষণ ব্যস্ত। প্রতিটি সেকেন্ড কাটছে তার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতায় ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত দেশ গড়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা। তবু তিনি রাজি হলেন। সময় দিলেন মাত্র ২০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যেই ভাষণ শেষ করে তাকে রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে। তবু নেতা-কর্মী-সমর্থকরা দারুণ খুশি। প্রিয় নেতা আসছেন এটাই যতেষ্ট। একনজর তাকে দেখা ও তার বজ্রকন্ঠে কিছু শুনার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকলেন।
সেদিন ছিল ৫ই মার্চ । এ উপলক্ষে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকের বিশাল মাঠে। জনতার ঢল নেমেছিল সেখানে সেদিন । প্রতিটি গ্রাম থেকে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত ছুটে এসেছিলেন শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত । প্রচুর মহিলাও এসেছিলেন সেদিন । আকাশযান হেলিকপ্টারে চড়ে বঙ্গবন্ধু এলেন। বাংলার মুকুটহীন রাজার পড়নে সেই চিরপরিচিত পোশাক সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি-মুজিবকোট। অপূর্ব লাগছিল তাঁকে।
মহানায়ক মঞ্চে আরোহণ করতেই উছলে উঠলো জনসমুদ্র। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে শ্লোগান উঠল জয় বাংলা জয় জয় হবে জয়, নৌকার হবে জয়। জাতির জনক দুহাত উর্ধাকাশের দিকে উত্তোলিত করে জনতার অভিবাদনের জবাব দিলেন। নির্ধারিত সময়ের মিনিটখানেক আগেই বঙ্গবন্ধর ভাষণ শেষ হল। এর আগে মরমী কবি গিয়াসউদ্দীন আহমদের ধন্যবাদ এ বঙ্গবন্ধু বাংলাই নয়নমণি/ধন্য নজরুল তাজউদ্দীন সামাদ কর্নেল ওসমানী গানটি গেয়ে শুনান বাউল শিল্পি মোহাম্মদ সফিকুন নূর।
বক্তব্য রাখেন আব্দুস সামাদ আজাদসহ অন্যান্য নেতারা । বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ করেই আর মঞ্চে না বসে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে এগিয়ে যেতে চাইলেন মঞ্চের সিঁড়ির দিকে। ঠিক তখনই মাইকে ঘোষণা করা হল, এখন গান গাইবেন বাউল শাহ আব্দুল করিম । অমনি নেতা ঘুরে দাড়ালেন । মাইকে ভেসে এলো তার ভরাট কন্ঠের অস্পষ্ট আওয়াজ, করিম গান গাইবে আর আমি চলে যাব, তা হয় না। গান শুনেই যাব। আবার মঞ্চে বসে পড়লেন তিনি।
অন্যদিকে বাউর সম্রাট শাহ আব্দুল করিম দরদভরা কন্ঠে উচ্চারণ করলেন নিজের লেখা অমর পঙক্তিমালা দরদি/বাংলার নাও সাজাইয়া/আমরা যাব বাইয়া। অকেন লম্বা গান,কিন্তু তন্ময় হয়ে গানটি শুনে দিরাই থেকে বিদায় নেন। প্রিয় সহযোদ্বা শাহ আব্দুল করিমকে বঙ্গবন্ধু সেদিন পাঁচশত টাকা নগদ সম্মানি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সেই নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ
Posted ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট ২০১৯
Sylheter Janapad | Sylheter Janapad