মখলিছ মিয়া, বানিয়াচং ॥ বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর নেই। ২০ডিসেম্বর রাত সাড়ে আটটায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে জটিল অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
রাতে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। ওদিকে ব্র্যাকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তার মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়ে বলা হয়, যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে শান্ত থাকা ও এগিয়ে যাবার শিক্ষাই তিনি সবসময় আমাদের দিয়েছেন। জীবনভর যে সাহস আর ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি আমরা তার মাঝে দেখেছি, সেই শক্তি নিয়েই আমরা তার স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানাব।
ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত তার মরদেহ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। দুপুর সাড়ে বারোটায় আর্মি স্টেডিয়ামেই নামাজে জানাজা সম্পন্ন হবে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলেসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার ১নং উত্তর পূর্ব ইউনিয়ন পরিষদের অর্ন্তগত কামালখানী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ব্রিটেনের গাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটা বাদ দিয়ে তিনি লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে এসে ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগ দেন এবং দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শেল অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এ সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মনপুরা দ্বীপের অধিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানে তাঁরা ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে ফজলে হাসান আবেদ সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ত্রাণকাজ শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা এলাকায় কাজ শুরু করেন। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়ই তিনি ব্র্যাক গড়ে তোলেন। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে তাঁর দীর্ঘ অভিযাত্রার সূচনা ঘটে। দরিদ্র মানুষ যাতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারে, সেই লক্ষ্যে তিনি তাঁর কর্মসূচি পরিচালনা করেন।
চার দশকের মধ্যে তিনি তাঁর অভূতপূর্ব নেতৃত্বের মাধ্যমে কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটান। ব্র্যাক পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তেরো কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে নিরলস কাজ কাজ করে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের সুযোগ্য নেতৃত্বই অজস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের অনন্য সাধারণ এই অর্জনকে সম্ভব করে তুলেছে। বস্তুত প্রতিষ্ঠাতার স্বাপ্নিক দূরদৃষ্টি, অদম্য সাহস এবং গতিশীলতা ব্র্যাকের ক্রম অগ্রযাত্রা, নব নব নিরীক্ষা ও সম্প্রসারণের নিরন্তর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে গেছে। ফলে দেশ-বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
Posted ১১:২৫ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০১৯
Sylheter Janapad | Sylheter Janapad