সুনামগঞ্জ জেলার হাওরগুলোর মধ্যে ৭০ ভাগ হাওরের বোরো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ধীরগতি । ৭৪৭ টি বাঁধ নির্মাণ এবং মেরামত প্রকল্পের মধ্যে সোমবার পর্যন্ত মাত্র ১৩ টি কাজ শুরু হয়েছে বলে দাবি করেছে পাউবো। বাস্তবে ওই ১৩ টিতেও কেবল কাজের আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে। কোথাও জোরে- শোরে কাজ শুরু হয় নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের কাজই শেষ হয় নি অর্ধেকেরও বেশি প্রকল্পের। সুনামগঞ্জ পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী অবশ্য দাবি করেছেন, পিআইসি গঠনের কাজ শেষ করে আগামী ২-৩ দিনের মধ্যেই বেশিরভাগ প্রকল্পে কাজ শুরু করবেন তাঁরা।
নীতিমালা মোতাবেক ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রকল্প নির্ধারণ করে পিআইসি গঠন এবং ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাঁধে কাজ শুরু হবার কথা ছিল। অথচ. গত ১৭ ডিসেম্বর জেলার মাত্র দুটি প্রকল্পে প্রতীকি কাজ শুরু হয়। সোমবার বিকালে পাউবো’র পক্ষ থেকে এই পর্যন্ত ১৩ টি বাঁধে কাজ শুরু হবার দাবি করলেও, বাস্তবে কোন বাঁধেই গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু হয় নি।
৭৪৭ টি প্রকল্পের জন্য ৭৪৭ টি পিআইসি গঠন হবার নিয়ম থাকলেও এই পর্যন্ত ৩৫০ টি পিআইসি গঠন হয়েছে। পিআইসি গঠনের কাজই শেষ করতে পারে নি উপজেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি।
সুনামগঞ্জের ৪৮ টি বড় হাওরের প্রায় ১৪ শ’ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামত, কোনো কোনো স্থানে (বিশেষ করে ক্লোজার) নতুন করে ক্লোজার নির্মাণের জন্য গত বছর পিআইসি হয়েছিল ৫৭২ টি। এবার সোমবার পর্যন্ত জেলার ১১ উপজেলায় ৭৪৭ টি প্রকল্প নির্ধারণ হয়েছে। এজন্য পিআইসিও ৭৪৭ টি গঠন করতে হবে। কিন্তু পাউবো’র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, জেলার ১১ উপজেলায় ৩৫০ টি’র মতো পিআইসি গঠন হয়েছে।
উপজেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি সূত্রে জানা গেছে, সরকার দলীয় প্রভাব এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের মনোনীতদের রাখতে গিয়েই বিলম্ব হচ্ছে পিআইসি গঠনে।
পাউবো’র একজন প্রকৌশলী পরিচয় উদ্ধৃত না করার অনুরোধ করে জানালেন, পিআইসি গঠনে নানামুখী চাপ ও তদবির থাকায় মূলত বাঁধের কাজ শুরু করতেই বিলম্ব হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ৬টি হাওরে ৫০ টি পিআইসি অনুমোদন হয়েছে। খাই ও দেখার হাওরে ১৪টি করে, সাংহাই, কাঁচিভাঙা ও জামখলা হাওরে ৫টি করে এবং কালাজুরি হাওরে ৭টি বাঁধের কাজ করা হবে। এই উপজেলায় এবার ৪৯ কি.মি বাঁধের কাজে ৯ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
পাউবো’র উপসহকারী প্রকৌশলী ফারুক আল মামুন জানান, আগামী ২৫ ডিসেম্বর পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি ডাবর পয়েন্টে বাঁধের কাজ উদ্বোধন করবেন।
ধর্মপাশা উপজেলার আটটি হাওরে ১১৭ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। এই উপজেলায় ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য এবার ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর ৩ টি বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা।
বিশ^ম্ভরপুর উপজেলায় ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য ৫ কোটি ৩৪ লক্ষ ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। বিশ^ম্ভরপুর উপজেলায় এখনো প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়নি। এবার উপজেলায় ২৬ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হবে। কমিটি গঠনের জন্য আবেদন চাওয়া হয়েছে। কিছু আবেদন জমাও পড়েছে। যাছাই বাছাইয়ের পর কমিটি গঠন করা হবে। আঙ্গুরালি, খরচার হাওরে এখনো পানি রয়েছে। বাঁধের কাজ শুরু করার উপযোগী হয়নি।
গত রোববার দোয়ারাবাজার উপজেলায় ৩৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। এবার দোয়ারাবাজার উপজেলার সদর ইউনিয়নে ১৬টি, নরসিংহপুর ইউনিয়নে ১টি, সুরমা ইউনিয়নে ৯টি, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে ২টি, মান্নারগাঁও ইউনিয়নে ১টি, পান্ডারগাঁও ইউনিয়নে ৫টি ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করা হবে। বাঁধ নির্মাণে ৫ কোটি ৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ এসেছে। একটি বাঁধেও কাজ শুরু হয় নি।
জগন্নাথপুর উপজেলায় ৪৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মধ্যে ১টি’র কাজ শুরু হয়েছে। বাকী ৪৪ টির কার্যাদেশ এখনো ( সোমবার পর্যন্ত) আসে নি।
এবার জগন্নাথপুরে ৪২.৩১০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করা হবে। এজন্য বরাদ্দ পাওয়া গেছে তিন কোটি টাকা। গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়া হাওরের পোল্ডার-২ এর আওতাধীন ৩২ নম্বর প্রকল্পের (পিআইসি) মইয়ার হাওরের পাশে স্থানীয় স্টিল ব্রিজের পশ্চিম অংশে বাঁধের কাজ শুরু করেছে।
তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়নের ২টি সহ মোট ৩ টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। হাওরের পানি কমছে না। এজন্য কাজ শুরু হচ্ছে না। তাহিরপুর উপজেলায় ৭০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা রয়েছে। এবার উপজেলায় ১৪ কিলোমিটার বাঁধের কাজ করা হবে।
শাল্লা উপজেলায় এবার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ১৩৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। ৯৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে ২৪ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। মঙ্গলবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মো. আল-মুক্তাদির হোসেন ছায়ার হাওরে বাঁধের কাজ উদ্বোধন করবেন।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা পাল জানান, এবার উপজেলায় ৫৫টি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হচ্ছে। কমিটি গঠনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উপজেলার পাগনার হাওরে এখনো প্রকল্পই নির্ধারণ হয় নি। আগামী সপ্তাহের মধ্যে প্রকল্প তৈরির কাজ শেষ হবে। এরপর বাঁধের কাজ শুরু হবে।
দিরাই উপজেলায় ৮৮ টি প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজ শুরু হয়েছে ২ টিতে। ছাতকে ১১ টি প্রকল্পের কোথাও কাজ শুরু হয় নি।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা কমিটি জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির কাছে ৫৬ টি প্রকল্পের প্রস্তাব দাখিল করেছে। এরমধ্যে পুরাতন বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ ও ক্লোজার নির্মাণের জন্য ২৭ টি প্রকল্প রোববার অনুমোদন হয়েছে। এই উপজেলায় কোন হাওর রক্ষা বাঁধে কাজ শুরু হয় নি।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিবুর রহমান বললেন, সোমবার পর্যন্ত জেলার ১১ উপজেলার বৃহৎ হাওর রক্ষা বাঁধের জন্য ৭৪৭ টি প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর প্রতীকিভাবে দুটি প্রকল্পে কাজ শুরু হয়। সোমবার পর্যন্ত ১৩ টি বাঁধে পিআইসি’র লোকজন কাজ শুরু করেছে। সোমবার পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ টি পিআইসি গঠন হয়েছে। পিআইসি গঠনে এখনো কিছু জটিলতা আছে। আশা করছি আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে সকল জটিলতা কাটিয়ে ওঠা যাবে এবং সব কয়টি প্রকল্পে কাজও শুরু করা যাবে।
Posted ৩:৩২ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯
Sylheter Janapad | Sylheter Janapad