ছবি- সিলেটের জনপদ
দুর্নীতির মায়াজালে বন্দী হয়ে পড়েছে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস। দালালদের দুর্নীতির কারণে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা পাসপোর্ট ও ভিসার গ্রাহকরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। সরকার সেবার মান বাড়ানোর জন্য ভাড়াটিয়া অফিস ছেড়ে নিজস্ব ক্রয়কৃত সিলেট নগরীর আলমপুর এলাকায় পাসপোর্ট অফিস স্থাপন করে। পাসপোর্ট অফিস নিয়ন্ত্রণের জন্য অফিস ও অফিসের বাইরে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না। দালালরা অসাধু অফিসার ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে দাপটের সাথে তাদের দালালী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের ১৭ জন স্টাফের মধ্যে ১৩/১৪ জন দুর্নীতির সাথে জড়িত। বিগত সময়ে পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা সমালোচনা এলেও পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষ কার্যত কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় দালালরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সিলেটের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে দালালদের সহযোগিতা করছেন আনছার সদস্য, অফিস সহায়ক, রেকর্ড কিপার, ডেসপার ড্রাইভার, দপ্তরী, নৈশ প্রহরী, পরিচ্ছন্ন কর্মী। বাহিরে পাসপোর্ট অফিসের সামনের কয়েকটি দোকানের মালিক, চুমকি স্টুডিও এবং বহিরাগত দালালরা। বহিরাগত অনেক দালাল পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাসপোর্টের গ্রাহকরা ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা না পেলেও দালালরা অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ৫/১০ মিনিটের মধ্যে তাদের কাজ সেরে নিচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে আনছার পরিচয়দানকারী পোষাক বিহীন অর্জুনের হাতে তিনটি পাসপোর্টের ফাইল দেখে তার পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায়, আমি পরিচালকের বডিগার্ড। পোষাক ছাড়া ডিউটি করছেন কেন জানতে চাইলে সে জানায়, আমার পোষাকের প্রয়োজন হয় না। পাসপোর্ট অফিসের গেইটের নিরাপত্তার কাজে থাকা তাজুল নামের আনছারের হাতে একটি পাসপোর্টের ফাইল দেখে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, একটি লোক পাসপোর্টের ফাইল জমা দেওয়ার পথ খোঁজে পাচ্ছে না, তাই আমি ঐ ফাইলটি হাতে নিয়ে দেখছি। এটা কি আপনার কাজ? জানতে চাইলে সে জানায়, মাঝে মধ্যে আমরা অনেক লোকদের সহযোগিতা করে থাকি।
গোলাপগঞ্জ পৌরসভার রণকেলী দক্ষিণভাগ গ্রামের মৃত আজিজুল আম্বিয়া চৌধুরীর ছেলে জিয়াউল হক চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, দালালদের নিয়ন্ত্রণে পুরো পাসপোর্ট অফিস। গত ২৬ জুন ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্টের ফাইল জমা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এসময় বহিরাগত দালালরা লাইন ছাড়াই ফাইল জমা দিতে দেখে প্রতিবাদ করায় দালালরা পুলিশ দিয়ে আমাকে মানসিক নাজেহাল করে। এসময় পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করে। পরে ২ জন সংবাদকর্মীর উপস্থিতি দেখে পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেয়। ঐদিন পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, একেকজন দালালের হাতে ৭/৮ টি করে পাসপোর্টের ফাইল রয়েছে। এসময় বেলাল নামের এক দালাল পাসপোর্ট অফিসের স্ক্যানার রুমে ৬/৭ টি পাসপোর্টের ফাইলে কাজ করার সময় তার সাথে আলাপ করা হলে সে জানায়, আমি পাসপোর্ট অফিসের লোক। কোন পদে আছেন জানতে চাইলে সে বলে, আপনার কাজ থাকলে দেন, কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আমার হাতে অনেক কাজ আছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঐ দালাল একটি ট্রেভেলসের মাধ্যমে দালালি করে আসছে। দুপুর আড়াইটার দিকে দেখা মিলে রেদওয়ান আহমদ নামের এক দালালের। এসময় তার হাতে ৫টি পাসপোর্টের ফাইল ছিল। পরবর্তীতে তার ব্যবহৃত মোবাইলে পাসপোর্টের বিষয়ে আলাপ করা হলে সে জানায়, পাসপোর্ট অফিসের এডি’র সাথে আমাদের কন্ডিশন রয়েছে। আপনার কোন কাজ থাকলে আমার ট্রেভেলসে নিয়ে আসতে পারেন। লাইনে না দাঁড়িয়ে কম সময়ের মধ্যে আমি আপনার কাজ করে দিতে পারব।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ঐ বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসকে ঘিরে রয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিক দালাল সদস্যরা। পাসপোর্ট অফিসের দালালদের তালিকায় রয়েছেন- সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৭নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারা পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে প্রভাব খাটিয়ে পাসপোর্ট ও ভিসার যে কোন কাজ আদায় করে আসছেন। এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের ডিরেক্টর মোঃ সাইদুল ইসলামের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, আমি বর্তমানে এই অফিসে নতুন, তবে খোঁজ খবর নিয়ে এক মাসের মধ্যে এসব নির্মুল করব। স্ক্যানার অফিস রুমে বসে পাসপোর্টের বেশ কয়েকটি ফাইলে দালালের স্বাক্ষররত একটি ভিডিও উপস্থাপন করলে তিনি পুরো স্টাফদের ডেকে ঐ ভিডিওটি দেখিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, উনি’ত আমাদের অফিসের কেউ না। উনাকে আমরা চিনি না। এ সময় আরো একটি ভিডিও উনার কাছে উপস্থাপন করলে তিনি বলেন, ঐ লোকটিও আমাদের কেউ না।
পাসপোর্ট অফিসের সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীদের নামের তালিকা চাইলে দুই ঘন্টা সময় ক্ষেপন করেও রহস্যজনক কারণে তারা তালিকা দিতে রাজি হয়নি। তবে নাম ছাড়াই ১৭ সদস্যের একটি পদবীর তালিকা তুলে দেওয়া হয় প্রতিবেদকের হাতে।
Posted ৩:২৭ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৮ আগস্ট ২০১৯
Sylheter Janapad | Sylheter Janapad